SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা সাহিত্য - কবিতা | NCTB BOOK

রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে

রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,

রানার চলেছে, রানার!

রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার ।

দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার -

কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার ।

রানার ! রানার !

জানা-অজানার

বোঝা আজ তার কাঁধে,

বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;

রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,

আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।

তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে সরে যায় বন,

আরো পথ, আরো পথ – বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ ।

অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিটমিট করে চায়;

কেমন করে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!

কত গ্রাম কত পথ যায় সরে সরে -

শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;

হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন, জোনাকিরা দেয় আলো

মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো ।

এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,

পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে'।

ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে

জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে ।

অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,

ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে ।

রানার! রানার!

এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?

রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?

ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,

পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,

রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,

দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে ।

কত চিঠি লেখে লোকে-

কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে ।

এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,

এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,

এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,

এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।

দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি,-

এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-

রানার! রানার! কী হবে এ বোঝা বয়ে?

কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?

রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে – আকাশ হয়েছে লাল

আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?

রানার! গ্রামের রানার!

সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;

শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
              ভীরুতা পিছনে ফেলে -

পৌঁছে দাও এ নতুন খবর,

              অগ্রগতির ‘মেলে’,

দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-

             নেই, দেরি নেই আর,

ছুটে চলো, ছুটে চলো, আরো বেগে

                  দুর্দম, হে রানার ॥

Content added || updated By

সুকান্ত ভট্টাচার্য ৩০শে শ্রাবণ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে কলকাতার কালীঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। তাঁর পিতা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং মাতা সুনীতি দেবী। সুকান্ত বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ধ্বংস ও মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা কিশোর সুকান্তকে দারুণভাবে স্পর্শ করে। এছাড়া সামাজিক নানা অনাচার ও বৈষম্য তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। তাঁর কবিতায় এই অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধ্বনিত প্রবল প্রতিবাদ আমাদের সচকিত করে। নিপীড়িত গণমানুষের প্রতি গভীর মমতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কাব্য : ছাড়পত্র, ঘুম নেই, পূর্বাভাস, অভিযান, হরতাল ইত্যাদি। ২৯শে বৈশাখ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে কবি মৃত্যুবরণ করেন।]
 

Content added By

রানার- ইংরেজি শব্দ ‘runner'-এর আভিধানিক অর্থ যিনি দৌড়ান । এখানে 'ডাক হরকরা' অর্থে ব্যবহৃত ।

নতুন খবর আনার— ডাক হরকরার ব্যাগে মানুষের সুখ-দুঃখের অনেক অজানা সংবাদ থাকে। চিঠি বিলি হলে সে সংবাদ মানুষ জানতে পারে। তাই ডাক হরকরাকে নতুন খবরের বাহক বলা হয়েছে।

দুর্বার- যাকে নিবারণ করা যায় না। হরিণের মতো যায়— এটি একটি উপমা হরিণ যেমন নিঃশব্দে কিন্তু অতি দ্রুত দৌড়ায়, রানারও তেমনি। লণ্ঠন— হারিকেন বা তেল দিয়ে চালিত আলোর আধার।

ভোর তো হয়েছে— আকাশ হয়েছে লাল— এটি প্রতীক। বাচ্যার্থে রাত্রির অন্ধকার শেষ হয়ে আকাশে সূর্য উঠছে। কিন্তু প্রতীকী অর্থে কষ্টের কালিমা দূরীভূত হয়ে সুখের সোনালি আলো দেখা দিচ্ছে।
 

Content added || updated By

পাঠ-পরিচিতি : সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'রানার' কবিতাটি কবির ছাড়পত্র কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। কবিতাটি শ্রমজীবী মানুষ রানারদের নিয়ে লেখা। তাদের কাজ হচ্ছে গ্রাহকদের কাছে ব্যক্তিগত ও প্রয়োজনের চিঠি পৌঁছে দেওয়া। রানাররা এতটাই দায়িত্বশীল যে কোনো কিছুই তাদের কাজের বাধা হয়ে ওঠে না। রাত হোক, দুর্গম পথ হোক, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হোক নিরন্তর তাদের এই কাজ করে যেতে হয়। চিঠি মানেই সুখে-আনন্দে, দুঃখে-শোকে ভরা সংবাদ। এই সংবাদের জন্যেই অপেক্ষায় থাকে প্রিয়জনরা। প্রিয়জনদের কাছে যথাসময়ে এই খবর পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। রানারদের তাই ক্লান্তি নেই, অবসর নেওয়ার অবকাশ নেই। তারা ছুটছেন তো ছুটছেনই। এই মহান পেশায় যারা নিয়োজিত রয়েছেন তারা যে মানুষ হিসেবে কতটা মহৎ, কবিতাটিতে এই ভাবনারই প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
 

Content added By